পিঙ্ক এবং পার্চ্‌ড: স্বপ্নপূরণের দুই অধ্যায়

লিখেছেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য ।

১৯৪৭-এর ১৫ই অগাস্ট আসতে তখনো বেশ কয়েক বছর বাকি। ভারতবর্ষের কোণায় কোণায় যদিও শুরু হয়ে গেছে অসহযোগের বীজ বপন। মানুষ স্বপ্ন দেখতে শিখছে স্বাধীনতার। সেরকম সময় ভারতবর্ষের কোনো এক গ্রামে এসে পৌঁছল ব্রিটিশ সরকারের এক ভারতীয় সুবেদার। গ্রামের প্রান্তে নদী। মেয়েরা সেই নদীতে জল ভরতে আসে। সেই নদীর ধারে সুবেদারের তাঁবু খাটানো হল। সুবেদারের চোখে লেগে গেল একটি মেয়েকে। কিন্তু সেই মেয়ে উপেক্ষা করল সুবেদারের লুব্ধ চাহনি, ছাড়িয়ে নিল তার কব্জির কাছে শক্ত হয়ে আসা আঙ্গুল। আর সুবেদার? সে ঠিক করল, যেমন করেই হোক, এই মেয়েকে তার চাই। তাই, গ্রামের প্রধান যখন কর লাঘব করার অনুরোধ জানালেন, সুবেদার তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন আরো একটি বোঝা। বলল, রাত্রে ওই মেয়েটিকে আসতে হবে তার কাছে। তাহলেই করের বোঝা কমে যাবে। গ্রামের পুরুষরা একজোট হল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, গ্রামের স্বার্থে মেয়েটিকে পাঠানো হবে সুবেদারের কাছে। আর মেয়েটি? সে কী বলল?

গরীব, অশিক্ষিত সোন বাঈ নামের সেই মেয়ে, যার সন্তান নেই, যার স্বামী সদ্য চাকরি পেয়ে শহরে চলে গেছে, সেই মেয়ে বলল, “আমি যাব না!” যাবে না? গ্রামের পুরুষেরা প্রথমে তাকে কথা দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করল। তাকে বোঝানো হল, সে স্বার্থপরের মত আচরণ করছে। তাকে বলা হল, নিজের দেমাকের জন্য সে সারা গ্রামকে বিপদে ফেলছে। কিন্তু সোন বাঈ অনড়। সে যাবে না। নিজের ঘর, নিজের গ্রামের রাস্তা তার কাছে তাই আর নিরাপদ থাকল না। সে আশ্রয় নিল একটি লঙ্কা গুঁড়ো করার কারখানার মধ্যে, যেখানে গ্রামের মেয়েরা কাজ করে। আবু মিঞা সেই কারখানার বৃদ্ধ দ্বাররক্ষী। দরজা বন্ধ তো হল। কিন্তু সোন বাঈ-এর দিকে এবার আঙ্গুল তুলল কারখানার বাকি মেয়েরা। কেন সোন বাঈ-এর জন্যে তারা আটকে থাকবে? অতএব, দরজা খুলে দেওয়া হোক। এক সময়ে ভেঙ্গে পড়ে সোন বাঈ, আবু মিঞাকে গিয়ে বলে দরজা খুলে দেওয়ার কথা; বলে, সে যাবে সুবেদারের কাছে। কিন্তু আবু মিঞা, বৃদ্ধ দুর্বল আবু মিঞা, দরজা খোলে না; সে জান দিয়ে দিতে পারে, জান দিতে হবে সে জানে, কিন্তু সোন বাঈকে সে যেতে দেবে না। ফিরে যায় সোন বাঈ। ততক্ষণে দরজার বাইরে এসে ভিড় জমিয়েছে গ্রামের লোক। সুবেদার আছে, ঘোড়ায় সওয়ার। তার আদেশে যেকোনো মুহূর্তে খসে পড়বে দরজার আগল, আবু মিঞার প্রতিরোধ ভেঙ্গে যাবে। কিন্তু, সুবেদারের চোখের আড়ালে, বন্ধ দরজার ওই পারে, বাতাস যেন দিক বদলাচ্ছে।

যথা সময়ে দরজা ভেঙ্গে গেল। আবু মিঞা’র ধুলোয় লুটিয়ে পড়া নিথর শরীর পার করে সুবেদার এসে দাঁড়াল কারখানার সামনে। আর তখন, ঠিক তখনই, অতর্কিতে আক্রমণ নেমে আসল। যে মেয়েরা ভয়ে বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়েছিল, তারা হঠাৎ হাতে তুলে নিল লঙ্কার গুঁড়ো, আর মুঠো মুঠো ছুঁড়ে দিতে লাগল সুবেদারকে লক্ষ্য করে। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে দু’হাত দিয়ে তার চোখ ঢেকে ফেলেছিল সুবেদার, নয়তো সে দেখতে পেত, সেই লাল রঙের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সোন বাঈ – যে তাকে ‘না’ বলেছিল।

‘না’ কোনো শব্দ নয়, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাক্য। ‘না’ মানে ‘না’। ‘না’ মানে হ্যাঁ নয়, ‘না’ মানে ‘হয়তো’ নয়, ‘না’ মানে ‘না’ ছাড়া আর কিচ্ছু নয়। সম্প্রতি এই কথাগুলো, ঠিক এই কথাগুলোই খ্যাতির আলো পেয়েছে অমিতাভ বচ্চনের গলায়, পিঙ্ক ছবিটিতে। কিন্তু কত দিন, কত মাস, কত বছর ধরে এই কথাগুলোই তো অক্লান্ত ভাবে বলে চলেছেন কতজন। অথচ, তাঁদের গলায় কথাগুলো শুনলেই আমরা কেমন নাক সিঁটকে বলি, “নারীবাদী!” যেন তা খারাপ কিছু। নারীবাদী মানে তারা পুরুষদের অপছন্দ করে, নারীবাদী মাত্রেই মনে করে সমস্ত পুরুষ ধর্ষক, নারীবাদীরা সবাই বড়লোক হয়, সবাই ফ্যাব ইন্ডিয়ার জামা আর বড় টিপ পরে, নারীবাদীরা শ্রেণি বৈষম্য নিয়ে মাথা ঘামায় না, নারীবাদীরা শুধু মধ্যবিত্তদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে, নারীবাদীরা…

কিন্তু যেই অমিতাভ বচ্চন বলল, তা মেনে নেওয়া সোজা হয়ে গেল। সহজেই ভুলে যাওয়া গেল, এই ভদ্রলোক এক মহিলার বিয়ে দিয়েছিলেন একটি গাছের সঙ্গে, তাঁর নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আগে (বিয়ে ‘দেওয়া’ শব্দটা সচেতন ভাবে ব্যবহৃত হল)। মনে নাও পড়তে পারে যে এই ভদ্রলোক গুজরাটের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। নাই মনে পড়তে পারে অমিত শাহ নামের আরেক ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কাহিনি। এইভাবে তর্ক চলতে পারে কিছুক্ষণ। অমিতাভ বচ্চনের পঞ্চাশটা দোষ ধরা যেতে পারে, এমনকি এও বলা যেতে পারে, অভিনেতা হিসেবেও তিনি ততটা উচ্চমানের নন। কিন্তু তাও, তাঁর বিখ্যাত ব্যারিটোনে এই কথাগুলো, এই অত্যন্ত জরুরি কথাগুলো অনেক, অনেক বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যায় অনেক সহজে। তাতে কি বদলায় কিছু? বোধহয় বদলায় না। যে ব্যক্তি আপাদমস্তক পিতৃতন্ত্রে ডুবে আছেন, একদিন অমিতাভের একটি ডায়লগে তাঁর কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু, এমনটা কবে ধরে নিয়েছি আমরা যে একদিনে একটা সিনেমা সব বদলে দিতে পারবে? আজ হঠাৎ আমরা ধরে নিলাম কেন যে একটি ছবি আজন্ম লালিত একটি ধারণাকে এক ধাক্কায় গুঁড়িয়ে দিতে পারবে? এই উচ্চাশার প্রেক্ষিতে পিঙ্ক দেখলে ছবিটি কখনোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে না, উঠতে পারেও না। পিঙ্ক সমাজ বদলাবে না। যদি পিঙ্ক-এর কিছু বদলানোর থাকে, তাহলে তা হল হিন্দি ছবির বাণিজ্যিক জগত। বক্স অফিসে পিঙ্ক-এর সাফল্যের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী কালে এক নবীন পরিচালকের নারীবাদী চিত্রনাট্য। পিঙ্ক-এর মত একটি ছবির সাফল্য নির্ধারণ করে দিতে পারে আরো পাঁচটা না তৈরি হওয়া ছবির ভবিষ্যৎ, প্রশস্ত করে দিতে পারে তাদের তৈরি হওয়ার পথ, পিঙ্ক-এর সাফল্যের জোরে কোনো এক তরুণী তার গল্প নিয়ে পৌঁছে যেতে পারে প্রযোজকের অফিস পর্যন্ত। অন্তুত এইটুকু আশা করা যেতে পারে। আর তাই আশা করা যেতে পারে যে যদি বছরে পিঙ্ক-এর মত অথবা পিঙ্ক-এর থেকে আরো অনেক অনেক ভালো একটা ছবি না রিলিজ করে একদিন দশটা, পনেরোটা ছবি রিলিজ করে, যদি আমাদের বোকা বাক্সে পুণ্যিপুকুর আর জলনুপূর দেখানো কমে আসে, তাহলে, তাহলে অন্তত কিছুটা পাল্টে যেতে পারে আমাদের শতাব্দী-শতাব্দী প্রাচীন ধারণা। তাহলে হয়তো, কিছুটা পাল্টাতে পারে সমাজ। আর মনে রাখা দরকার, পিঙ্ক অথবা পিঙ্ক এর মত, অথবা পিঙ্ক এর থেকে ভালো ছবি তৈরি হওয়ার পেছনে কিন্তু আসলে থেকে যায় ওই হাজার অক্লান্ত কন্ঠস্বর, যাদের ব্যারিটোন না থাকলেও গলায় যথেষ্ট জোর আছে।

‘যথেষ্ট নারীবাদী নয়’, অথবা, ‘আদপেই নারীবাদী নয়’ – এইরকম দু’টি অভিযোগ পিঙ্ক-এর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। প্রথম অভিযোগটির কারণ ওই অমিতাভ বচ্চন। অর্থাৎ, ছবিটির আর সব কিছু ঠিক আছে, শুধু অমিতাভের জায়গায় থাকতে হত কোনো নারী চরিত্র। ধরে নেওয়া যাক, তাই হল। ধরে নেওয়া যাক, অমিতাভ বচ্চনের জায়গা নিলেন দীপিকা পাডুকোন। দীপিকা পাডুকোন কেন? কারণ, হিন্দি ছবির জগতে আপাতত তিনিই নাকি সাফল্যের শীর্ষে। গত তিন বছরে তাঁর অভিনীত একাধিক ছবি একশো কোটি টাকার ওপর ব্যবসা করেছে সারা পৃথিবী জুড়ে। এমনকি ‘তামাশা’, যা বক্স অফিসের নিরিখে ‘ফ্লপ’, সেও ঢুকে পড়েছে এই পরিসংখ্যানের তালিকায়। জনপ্রিয়তার কথা ধরলেও তিনিই প্রথম। অতএব, অমিতাভ বচ্চন আউট, দীপিকা পাডুকোন ইন। তাহলেই ‘যথেষ্ট’ নারীবাদী হয়ে যায় পিঙ্ক। আমি, আপনি – আমরা যারা কিছুটা সচেতন, আস্তে আস্তে ঝেড়ে ফেলতে শিখছি পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, আমাদের কাছে আরো দু’নম্বর বেশি পায় ছবিটা। কিন্তু যে লোকটা অমিতাভ বচ্চনের জন্য সিনেমা হলে যায় (ধরা যাক আমি বা আপনি যাই না), সে কিন্তু দীপিকা পাডুকোনকে দেখে আর নাও যেতে পারে। অথবা, যেতে পারে তার কথা শুনতে নয়, তাকে ‘দেখতে’। বাস্তব এটাই যে অমিতাভ বচ্চনের গলা দীপিকা পাডুকোনের থেকে জোরালো। আর এই বাস্তবকে মাথায় না রেখে ‘পিঙ্ক’ এ অমিতাভের উপস্থিতিকে বোঝা অসম্ভব। কাজেই, প্রশ্ন হল, যে সংলাপ অমিতাভ বচ্চনের চরিত্র উচ্চারণ করছে তার গুরুত্ব নিয়ে। সেই কথাগুলো কে বলল সেটা গুরুত্বপূর্ণ বেশি, নাকি কে শুনল সেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ? এক্ষেত্রে, অর্থাৎ একটি মূলধারার বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির ক্ষেত্রে, মেয়েদের ‘না’ বলার অধিকার নিয়ে কথা বলাটা বেশি জরুরি, নাকি বক্তা’র লিঙ্গ? যে কোনোদিন শোনেইনি যে মেয়েদের ‘না’ বলার অধিকারের কথা, নারী স্বাধীনতার কথা, তাকে কথাটা কে বলল তাতে কী যায় আসে? যদি কথাটা ঠিক হয়, যদি বক্তব্যে কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে যেই বলুক না কেন, কথাটা যে বলা হচ্ছে, এবং শোনা হচ্ছে, সেটাই কী প্রাথমিক ভাবে সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়?

এখানেই পিঙ্ক নিয়ে দ্বিতীয় সমস্যা। পিঙ্ক আদপে নারীবাদী নয়। পিঙ্ক আসলে মেয়েদের সমস্যার কথা তুলে ধরতেই পারেনি। পিঙ্ক-এ যা দেখানো হয়েছে তার সঙ্গে মেয়েদের বাস্তব অভিজ্ঞতার কোনো সম্পর্ক নেই। নারীবাদের সঙ্গে, আমরা জানি, বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্পর্ক আছে। বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই নারীবাদ গড়ে ওঠে। এই কারণেই নারীবাদ বলতে কোনো একটি তত্ত্বকে বোঝানো হয় না। ধরে নেওয়া যাক একজন মহিলার কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই বিয়ে হয়ে গেছে, বছর দুয়েকের মধ্যে সন্তান, বর কর্পোরেট হাউসে চাকুরে, বাইপাসের ধারে নিজেদের ফ্ল্যাট, গাড়ি। অনেক সময় অনেকের থেকে এই মহিলাকে শুনতে হয়েছে, শুনতে হয়, তাঁর চাকরি করার কোনো ‘দরকার নেই’। তাঁর বরের অনেক মাইনে, তাছাড়া বাড়িতে সন্তান আছে, তার স্কুল আছে, আঁকার ক্লাস আছে। চাকরি করলে এসব দেখবে কে? হয়তো তিনিই দেখেন। সকালে উঠে জলখাবার, ভাত-মাছ, আঁকার ক্লাস, হোমওয়ার্ক, রুটি-আলুর দম – উনিই সামলান। সিঁথিতে সিঁদুর। হাতে লোহা। কিন্তু চাকরিটা ছাড়েন না। এই মহিলা, বাসে, অটোতে হামেশা যাঁর সাথে, যাঁদের সাথে দেখা হয় আমার, আমাদের অনেকের; যিনি ওই সকাল বেলা রান্নাঘর, দুপুরবেলা অফিস, আর বিকেলবেলা আঁকার ক্লাস; যিনি সিঁদুর আর তাঁতের শাড়ি কিন্তু বেড়াতে গেলে সালোয়ার – তিনিও একটু হলেও লড়াই করছেন পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। তাঁর মত করে। তাঁকে কি নারীবাদী বলব আমরা? আর যে মহিলা কোমরে জড়ানো আঁচল, সেই মহিলার বাড়িতে ঘর মুছতে ঢুকলেন, তিনিও যখন নিজের রোজগারের জোরে ঘর থেকে বের করে দেন তাঁর গায়ে হাত তোলা বরকে, কিন্তু  হাতের শাঁখাটা খোলেননা, তখন পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আমার-আপনার লড়াই থেকে কী তিনি বাদ? নাকি আমাদের তত্ত্ব আর বাস্তব জগতের মধ্যে দূরত্ব বাড়বে, আর আমার তত্ত্বের সঙ্গে না মিললে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে একজন মেয়ের স্বতঃস্ফূর্ত লড়াইকে নারীবাদী আখ্যা দিতে অসুবিধে হবে আমার, কারণ তার হাতে শাঁখা-পলা, কপালে সিঁদুর? একজন মেয়েকে একটা পার্টিতে গিয়ে হেনস্থা হতে হল, সে প্রতিবাদ করল, নিজেকে বাঁচানোর জন্য  আততায়ীকে আঘাত করল, কিন্তু তারপর পুলিশের কাছে গেল না। এই দেশে  বেশির ভাগ মেয়েই যায় না পুলিশের কাছে। কিন্তু যে ছেলেটি হেনস্থা করেছিল, সে ঠিক করল প্রতিশোধ নিতে হবে। অপমানের প্রতিশোধ। তাকে নাকচ করার প্রতিশোধ। তাই সে নানাভাবে মেয়েটিকে এবং তার দুই বন্ধুকে হেনস্থা করতে শুরু করল। দু’পক্ষই পুলিশের কাছে অভিযোগ করল। যদিও মেয়েটির অভিযোগ নিতে প্রথমে প্রায় অস্বীকারই করেছিল পুলিশ। এত অব্দি শুনে খুব অবাস্তব মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে এরকমটা হয় না ভারতবর্ষে? যাই হোক। কোর্টে কেস উঠল। ছেলেটির পক্ষের উকিল প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন যে মেয়েগুলো আসলে বেশ্যা। বেশ্যা, অতএব না বলার অধিকার নেই। চেনা শোনাচ্ছে না কথাগুলো? মনে পড়ছে না পার্ক স্ট্রিট? সুজেট জর্ডানের কথা? মনে পড়ছে না কোনো একটি বাংলা নিউজ চ্যানেলে বসে অর্পিতা ঘোষ প্রায় বলেই ফেলছেন, বেশ্যাদের ধর্ষণ করা অপরাধ নয়! পিঙ্ক দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল বারবার, এই বুঝি পা ফস্কে গেল। বারবার যখন প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে মেয়েগুলি আসলে বেশ্যা, মনে হচ্ছিল, তাহলে কী এখানে এসে পুরো মুখ থুবড়ে পড়বে ছবিটা? এরাও বলবে তাহলে যে বেশ্যারা খুব খারাপ আর তাদের ধর্ষণ করা যায়? কী বলল পিঙ্ক? সাক্ষ্য দিতে গিয়ে কির্তি কুলহারি অভিনীত চরিত্রটি বলে উঠল, ‘হ্যাঁ’! আমরা টাকা নিয়েছিলাম! কিন্তু যদি টাকা নিয়েও থাকি, টাকা নেওয়ার পর কী আমার মত বদলে যেতে পারে না? আর যদি বদলে যায়, তখন কী আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে আমার শরীরে হাত দেওয়া আইনের চোখে অপরাধ নয়?” অমিতাভ বচ্চনের নাটকীয় মনোলগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছেন কির্তি কুলহারি, যাতে অমিতাভ শেষে বলতে পারেন, ‘না মানে না।’ না বলা মানে তার শরীরে হাত দেওয়া যাবে না। ‘সে  আপনার বন্ধু হোক, প্রেমিকা হোক, বেশ্যা হোক, বা আপনার স্ত্রী। না মানে না।’ আমরা অনেকে হয়তো জানি, ‘না’ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাক্য হলেও ‘না মানে না’ – এই বাক্যটির পরে আরো অনেকগুলো বাক্য বলতে হবে, জানাতে হবে। বলতে হবে, একমাত্র ‘হ্যাঁ’ মানে ‘হ্যাঁ’। ‘না’, ‘হতেও পারে’, ‘হয়তো’, ‘জানি না’ এবং এই জাতীয় অন্যান্য শব্দ অথবা শব্দবন্ধের অর্থ ‘হ্যাঁ’ নয়। পিঙ্ক বলেনি এই কথা। পিঙ্ক বলেনি, কিন্তু আমরা জানি, শুধু শহুরে মধ্যবিত্ত মেয়েরা নয়, প্রতিদিন নানাভাবে লাঞ্ছিত, অপমানিত, অত্যাচারিত, নিগৃহীত হতে হয় সমাজের সমস্ত শ্রেণির মেয়েদের। কিন্তু আমরা তো এও জানি যে ওই প্রথম কথাগুলোই এখনো পৌঁছতে পারেনি বেশির ভাগ মানুষের কাছে। বেশির ভাগ মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে বাংলা আর হিন্দি সিরিয়াল, পৌঁছে যাচ্ছে ‘গ্র্যান্ড মস্তি’, ‘100% লাভ’ (Love) আর আইটেম নাম্বার। সেখানে পিঙ্ক-এর দৌড় অবশ্য শুধু শহরাঞ্চলের সিনেমা হল। কিন্তু অন্তত সেখানে কয়েক সপ্তাহ রোজ পর্দায় কয়েকটা মেয়ের লড়াইয়ের গল্প তো বলা হবে, অন্তত কয়েকটা লোক তো রোজ শুনবে, জানবে, হয়তো বুঝবে, “না কা মত্‌লব সির্ফ্‌ না হোতা হ্যায়।”

পিঙ্ক-এর বিরুদ্ধে আপাতত শেষ অভিযোগ – আদালতের দৃশ্য বাস্তবসম্মত নয়। সিনেমার শেষ বাস্তবসম্মত নয়। পিঙ্ক-এর অতি বড় গুণমুগ্ধ দর্শকও এই অভিযোগ অস্বীকার করতে পারবেন না। ভারতবর্ষের আদালত ওরকম দেখতেও হয় না, সেখানে ধৃতিমানের মত বিচারক থাকেন না, অমিতাভ বচ্চনের মত উকিল তো থাকেনই না। আর সব থেকে বড় কথা, এই দেশে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করে বিচার পাওয়া এত সহজে সম্ভব নয়। পিঙ্ক-এর চিত্রনাটকার একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, প্রথমে পিঙ্ক-এর শেষটা অন্যরকম ছিল না। সেই বাদ দেওয়া শেষ অংশে মেয়েরা মামলা হেরে যেত, জয় হত অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছেলেটির। তেমনটাই হয় এই দেশে। তাহলে কেন এই প্লট পরিবর্তন? স্বপ্নভঙ্গের চেয়ে স্বপ্নপূরণের গল্প বাজারে বিক্রি করা সহজ, এই কী কারণ? নাকি একবার দেখে নেওয়া, কিরকম হলে ভালো হত আমাদের বাস্তব আর বাস্তবে তার থেকে কতটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমরা?

এরকমই আরেকটি স্বপ্নপূরণের গল্প পিঙ্ক-এর কিছুদিনের মধ্যেই মুক্তি পেয়েছিল ভারতবর্ষে। পার্চ্‌ড। এখানেও গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে তিনজন নারী আর তাদের বন্ধুত্ব। লাজো, রানি আর বিজলি। প্রথম দু’জন গুজরাতের কোনো গ্রামের বাসিন্দা। লাজো বিবাহিতা, নিঃসন্তান। রানি বিধবা। আর বিজলি নাচ করে – গ্রামের সীমানায় তাঁবু খাটিয়ে আইটেম নাম্বারের তালে তার শরীর বিক্রি হয়। লাজোর বর রোজ রাতে মদ খেয়ে এসে তাকে মারে। রানির ছেলে তার চোখের সামনে নিজের কিশোরী বউয়ের ওপর অত্যাচার করে। রানিই কিন্তু বিয়ে ‘দিয়েছে’ তার।  রানি আর বিজলি যে গ্রামে থাকে সেটি যে অত্যন্ত রক্ষণশীল তা প্রথমেই এস্‌ট্যাব্লিশ করা হয় ছবিতে। ধর্ষিতা মেয়েকে  পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্তে তুলে দেওয়া হয় তার ধর্ষকদের হাতেই কারণ তারা মেয়েটির শ্বশুরবাড়ির লোক। গ্রামের মেয়েদের মোবাইল ব্যবহার করার অধিকারও পঞ্চায়েতের হাতে। গ্রামে টিভি আসবে কিনা তাও ঠিক করে দেন পঞ্চায়েত প্রধানরা। ঝক্‌ঝকে ছবির মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে বাস্তব ভারতবর্ষ। এত ঝক্‌ঝকে যে চোখে লাগে। বিজ্ঞাপনের মত লাগে। রানি, লাজোরাও যেন সেই বিজ্ঞাপনেরই চরিত্র। দরিদ্র, রক্ষণশীল, সামন্ততান্ত্রিক, গ্রাম্য ভারতবর্ষের কী এক্সোটিক সেই বিজ্ঞাপন! হাতে যেন লিস্ট ধরিয়ে দেওয়া আছে – একেকটা করে সমস্যা একবার করে ছুঁয়ে যেতে হবে। মেয়েদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিচ্ছে না খাপ্‌ পঞ্চায়েত। চেক্‌। শ্বশুরবাড়ির একাধিক পুরুষ ধর্ষণ করেছে বাড়ির নতুন বউকে। চেক্‌। ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মেয়েদের অপমান করা হয়, তাদের ‘নেপালি’ বলা হয়, তাদের ভারতীয় বলে স্বীকার করা হয় না। চেক্‌। বাল্যবিবাহ। চেক্‌। বিধবা। চেক্‌। বন্ধ্যা। চেক্‌। বেশ্যা। চেক্‌। সমকামিতা। চেক্‌। তালিকা যত বাড়বে তত ধাঁধিয়ে যাবে চোখ। বিজলি একটি আশ্চর্য গাড়ি চালিয়ে ঘুরে বেড়াবে গোটা গ্রাম, আর তার সঙ্গী হবে রানি আর লাজো, কিন্তু কেউ ফিরেও তাকাবে না। আপনিও না, কারণ ভারতবর্ষের এই বিজ্ঞাপনে ততক্ষণে আপনিও মশ্‌গুল। রানি, বিজলি, আর লাজো এক দূর্গের ভগ্নস্তুপের ওপর থেকে চেঁচিয়ে বলবে, “কাকাচোদ্‌, ভাইচোদ্‌, বাবাচোদ্‌”। কেন সমস্ত গালাগালের আগে বসবে মা, বোন, কিংবা বেটি? বসা উচিৎ নয় মোটেই। এই পপকর্ণ সমানাধিকারের দুনিয়ায় সাম্য আসবে গালাগালের শব্দ বদ্‌লে, সমাজের নিয়ম বদলালো কী না তাতে কীই বা আসে যায়? তবে, যদি এই অদলবদলের প্রসঙ্গে নাও যাই, এটা একবার ভেবে দেখা উচিৎ ছিল বিজলির, তার তৈরি গালাগালগুলো মেয়েদেরই লক্ষ্য করে বলা যায়, উল্টো ক্ষেত্রের গালাগালগুলো যেমন বলা যায় ছেলেদেরই লক্ষ্য করে।

ভারতবর্ষের এহেন গল্পে রামায়ণ বা মহাভারত থাকবে না, এ তো হতেই পারে না। নারীকে দেবীরূপে কল্পনা না করতে পারলে এই বিজ্ঞাপন সার্থক হয় না। অতএব, ছবির শেষাংশে মেলার মাঠে পুড়তে থাকে রাবণের দেহ, শোনা যায় দুর্গার স্তব, নারীশক্তির উপাসনা, আর অন্যদিকে লাজো আগুন লাগিয়ে দেয় তার নিজের ঘরে যার ভেতরে তার বর মদ খেয়ে পড়ে আছে। লাজো, রানি, আর বিজলি গ্রাম থেকে পালাবে স্থির করে। বিজলির সেই অদ্ভুত গাড়িতে চড়ে তিনজন যাত্রা শুরু করে। রাতের অন্ধকার কেটে যায়। দিনের আলোয় দেখা যায় সামনে রাস্তা দু’ভাগ হয়ে গেছে। কোন দিকে যাবে ওরা? লাজো বলে, যেদিকে ওদের যেতে ইচ্ছে করবে।

সোন বাঈ কিন্তু যায়নি। গ্রামের সবাই যখন একদিকে, আর অন্যদিকে সে একা, তখনো সে চলে যায়নি। যেমন যায়নি মিনল, ফলক্‌, আর অ্যান্ড্রিয়া তাদের দিল্লির ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথাও। সেটাই তো জিত আসলে। সুবেদারের চোখে লঙ্কা গুড়োঁ ছুঁড়ে মারা, অথবা মামলা জিতে যাওয়া – এসব নয়। যেকোনো পরিস্থিতে, যেকোনো সমস্যায় নিজের ইচ্ছে মত হ্যাঁ অথবা না বলতে পারা – সেটাই তো জিতে যাওয়া। মির্চ মসালা আর পিঙ্ক সেই জিতে যাওয়ার গল্প। স্বপ্নপূরণ।

 

This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

2 Responses to পিঙ্ক এবং পার্চ্‌ড: স্বপ্নপূরণের দুই অধ্যায়

  1. মানস চক্রবর্তী বলেছেন:

    আনবায়াসড এই লেখাটা ভাল লাগল সর্বজয়া। সিনেমাটা হয়ত সেই সিনেমা নয় যেটা আমি দেখতে চাই। সিনেমাটা হয়ত আমাকে খোলা আকাশের নিচে টেনে এনে দাঁড় করায় না। তবুও কিছু স্পর্ধা দেখায় বইকি। অন্তত আমার জন্য হিন্দি সিনেমা না দেখার গোঁড়ামিতে আঘাত করতে সক্ষম হল লেখাটি।

    Liked by 1 person

  2. Sarbajaya Bhattacharya বলেছেন:

    অনেক ধন্যবাদ মানস দা!

    Like

Sarbajaya Bhattacharya এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল