লিখেছেন সর্বজয়া ভট্টাচার্য।
লেইলা ও যুদ্ধের ছায়াগুলি
যখন আকাশ থেকে নেমে আসছে সাদা ফস্ফরাস আর চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে স্কুলবাড়ি, যখন চারিদিকে ঘন অন্ধকার আর মাঝে মাঝে আগুনের গোলা, তখন পালাতে পালাতে যদি চোখে পড়ে সমুদ্রের ধারে চার জন কিশোর, পায়ে ফুটবল, জানে না এক্ষুণি আকাশ থেকে নেমে আসবে, ঝড় নয়, বোমারু বিমান, জানে না, এতক্ষণে পুড়ে গেছে ঘর-বাড়ি-সাইকেল-বইখাতা, তখন তাদেরও জানান দেওয়া, তাদেরও সঙ্গে নেওয়া, স্বাভাবিক, নয়? স্বাভাবিক। লেইলার কাছে, মানে আপনার কাছে, আপনি যিনি মোবাইলের পর্দায় এতক্ষণ নিজেকে, মানে লেইলার বাবাকে, আর মাঝে মাঝে লেইলাকেও বাঁচিয়ে রেখেছেন, আর সেই আপনিই যিনি কিছু না করতে পেরে শুধু দেখেছেন লেইলার মা’র মাটিতে লুটিয়ে পরা দেহ, আর পালাচ্ছেন, পালাতে বাধ্য হচ্ছেন ছেড়ে আপনার ঘর-বাড়ি-ভিটে-মাটি-থালা-বাটি-ফুলের বাগান, সেই আপনার কাছে আপনার হাতের তালুতে রাখা যন্ত্র জিজ্ঞেস করছে, আপনি ওই চার কিশোরকে সঙ্গে নেবেন কিনা। আর আপনি – উদার, সহমর্মী, মানবিক – আপনি বলছেন, হ্যাঁ। আপনি মানে আসলে লেইলার বাবা, তার মানে, আসলে লেইলার বাবা বলছেন, হ্যাঁ। আর খুশি হয়ে লেইলা – মা-হারানো, স্কুল-হারানো, বাড়ি-হারানো, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, আহত সেই ছোট্ট মেয়েটা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। ঠিক যতটা সময় লেইলার লেগেছে তার বাবার থেকে, অর্থাৎ কিনা আপনার থেকে ঐ চার কিশোরের কাছে পৌঁছতে, সেই কয়েক মুহূর্তে দিগন্তরেখা ঢেকে দিয়েছে জাহাজের মাস্তুল, আর সেই জাহাজ থেকে সমুদ্র পেরিয়ে ছুটে এসেছে মৃত্যু পরোয়ানা। আর যে কয়েক মুহূর্ত লেগেছিল লেইলার ওই দূরত্বটুকু পার করতে, এমনকি আপনার, বা লেইলার বাবা’র যতটা সময় লেগেছিল ওদের সাথে নেওয়ার সিদ্ধান্তে পৌঁছতে, তার থেকে অনেক কম সময়ে লেইলার বাবার, অর্থাৎ আপনার চোখের সামনে ছাই হয়ে গেছে পাঁচটা কৈশোর।
কিন্তু মোবাইল তো, তাই আপনার সুযোগ আছে আবার। ড্রোন বাঁচিয়ে, বোমা বাঁচিয়ে, আপনার, মানে লেইলা’র বাবা আর লেইলার আরেকবার সুযোগ আছে ওই সমুদ্রের ধারে পৌঁছে যাওয়ার। আর আপনার, মানে লেইলার বাবা’র সুযোগ আছে ‘না’ বলার। আপনি, মানে লেইলার বাবা। আপনি জানেন, হ্যাঁ বলার পরিণতি। তাই এইবার, এইবার আপনি না বলবেন। নইলে এগোতে পারবেন না। এগোলেই দেখবেন, অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে কালো, চারিদিকে বোমা আর বোমাবাহী প্লেনের আওয়াজ, তার মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স-এর লাল আলো, সাইরেন-ধ্বনি! তবে এখানেও সমস্যা আছে। জায়গার অভাব। একজন, শুধু একজনকেই আর নিতে পারবে ওরা। এইখানে এসে আপনাকে আর সিদ্ধান্ত নিতে হবে না কোনো। আপনি এখানে পৌঁছনোর আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া আছে, তাই আপনি, মানে খানিকটা আপনি যিনি বাড়িতে, অফিসে, বাসে, গাড়িতে, কলেজে, মাঠে, ট্রেনে মোবাইলে চোখ সেঁটে বসে আছেন, আর খানিকটা আপনি যিনি আসলে লেইলার বাবা, আপনি দেখবেন, লেইলা উঠে পড়ছে অ্যাম্বুলেন্সে, আর পরক্ষণেই অ্যাম্বুলেন্স ফেটে যাচ্ছে বোমার আঘাতে, আর আপনি সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে তুলে আনছেন আপনার মেয়ের, মানে, লেইলা’র মৃতদেহ।
তারপর? তারপর সেই অ্যাম্বুলেন্সের ধ্বংসাবশেষ থেকে, সেই সমুদ্রের ধার থেকে, রাস্তা থেকে, স্কুল থেকে, বাড়ি থেকে, সমস্ত মাটি থেকে তারায় ভরা আকাশের দিকে উঠে যাবে কত কত নীল বিন্দু, উঠে যাবে, মিশে যাবে, অন্ধকারে, আকাশে, হাওয়ায়, বড্ড বেশি নীল বিন্দু, উঠে যাবে, উঠে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে, হাওয়ায়, অন্ধকারে, আকাশে।
বেয়াদপ বাচ্চা অথবা সন্ত্রাসবাদী’র কবিতা
গাজা’র বেয়াদপ বাচ্চাগুলো,
তোরা, যারা সারাক্ষণ আমায় উত্যক্ত করেছিস
হল্লা করে জানলার তলায়
তোরা, যারা প্রতিটা সকালে ভরে দিতি হট্টগোল, তাড়া…
তোরা, যারা ফুলদানি ভেঙে চুরি করে নিয়েছিলি
আমার বারান্দা থেকে একলা ফোটা ফুল…
ফিরে আয়
আর হল্লা কর যত চায় প্রাণ
ভেঙে ফেল সব ফুলদানি
সমস্ত ফুল চুরি কর
ফিরে আয়,
শুধু, ফিরে আয়!
হামেশা সামিদা
ওসামা বলছে, “আমাদের স্কুলে কোনো জানলা ছিল না”, আর আমার মনে পড়ে যাচ্ছে সতেরো নম্বর ঘর, প্রবল গ্রীষ্মের দুপুর, ক্লাসের মাঝখানে জানলা থেকে ঝুঁকে পরা উৎসুক চাহনি। আমার মনে পড়ে যাচ্ছে তিন তলার বারান্দায় যেদিন জাল বসানো হল, সেদিন সকালে ক্লাসে যাওয়ার সময় আমাদের মন খারাপ, অন্ধকার মুখ। ওসামার স্কুলে জানলা ছিল না যাতে অতর্কিতে বোমা ঘরের মধ্যে না ঢুকে আসে। ওসামার স্কুলে, জাল-ও নেই, শুধুই দেওয়াল।
আসলে, দেওয়াল তুলে বোমা আটকানো তো যায় না শেষ পর্যন্ত। তাই একদিন ওরা, ওরা মানে ওসামা, ওর নাটকের দলের বন্ধুরা, হয়তো বা লেইলা আর লেইলার বাবা (মানে আপনি, অন্তত খানিকটা আপনি), ওরা বেরিয়ে পড়ল। ওদের বাড়ির পাশের মাঠে অলিভ গাছ পড়ে থাকল, উনুনে হাঁড়ি পড়ে রইল, পোষা কুকুর থেকে গেল, আলনায় শাড়ি, দড়িতে ভিজে জামা – সব থেকে গেল। দরজা খোলা থেকে গেল। ওরা চলে গেল, কাঁধে সিন্দুক, হাতে চাবি। যে দরজা খোলা থেকে গেছে, তার চাবি। সেই দরজাতে তালা লাগানোর অধিকারটুকুও অজান্তে খুইয়ে ওরা চলে গেল। ওরা মানে ওসামা, আবু, লেইলা, লেইলা’র বাবা, আমার আম্মা আর তাঁর কোলে আমার তিনের দশকে জন্মানো বড় জেঠু যার নাম স্বদেশ (যে একবার খুব ছোটবেলায় নাকি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিল যদিও সেই দৃশ্য তার মনে থাকার কথা নয়), আর শুভ্রদা’র ঠাকুমা যাঁর আঁচলে আমৃত্য বাঁধা ছিল সেই চাবির গোছা।
ওরা কয়েকজন তারপর একে একে জেনিনের রিফিউজি ক্যাম্পে এসে পৌঁছয়। ইসরায়েল অবশ্য এদের রিফিউজি বলে না। আসলে উদ্বাস্তু বলে স্বীকার করলে স্বীকার করে নিতে হয় ফিরে আসার অধিকার, অধিকার না হলেও, সম্ভাবনা। তাই রিফিউজি নয়। বরং সন্ত্রাসবাদী। সন্ত্রাসবাদী বললে আগুন ঝরানো আরো সহজ, মানবাধিকার কর্মীদের কথা ভুলে যাওয়া আরো সহজ, পৃথিবীর আক্রোশের হাত থেকে রেহাই পাওয়া তো খুব সহজ, আর আরো সহজ পাওয়া আমেরিকার বন্ধুত্বের হাত। আরো অস্ত্র, আরো আগুন, আরো জানলা ছাড়া স্কুলবাড়ি। জেনিনের রিফিউজি ক্যাম্পে কোনো স্কুল বাড়ি নেই। কিন্তু ফ্রিডম থিয়েটার আছে। মুক্তি-যোদ্ধারা আছে।
পৃথিবীর বদ্হজম এবং শেষ রিফিউজি
“রিফিউজি হওয়া মানে লাইনের একদম পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা
একফালি দেশের আশায়।”
এই দুই পংক্তির লেখক প্যালেস্টাইনের কবি ও চিত্রকর আশ্রাফ ফায়াদ সৌদি আরবের বাসিন্দা। কবিতা লেখার গুরুতর অপরাধে তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীতে স্বর্গ যদি কোথাও…
ট্রেন চলতে চলতে এক সময় যখন শহর সরে সরে যায়, ইঁটের দেওয়াল সরে যায়, পাকা বাড়ি সরে যায়, শহরের গন্ধটাও ফিকে হয়ে আসে, আমার জানলার বাইরে তখন প্রচন্ড সবুজে মাঠ ছেয়ে গেছে। কত দূর অব্দি অবলীলায় চলে যাচ্ছে চোখ। আড়াই ঘন্টার রাস্তায় আমি গুণতে শুরু করি, ক’টা লোক ক্ষেতের মাঝখানে, ক’টা গরু। সরু সরু কাঁচা রাস্তা দেখে ভাবি, এইখানে যদি নেমে যাওয়া যেত, যদি হেঁটে যাওয়া যেত না গিয়ে শান্তিনিকেতন এই নিয়ে আট বার। ভাবি, এইবার যদি বড়রা কেউ বলে ওঠে, “চল, নেমে পড়ি।” আর আমি, এক পায়ে খাড়া, ব্যাগ কাঁধে লাফিয়ে প্ল্যাটফর্মে নামি। কিন্তু হয় না। লোক-গরু-ক্ষেত সরে যায়, সরু রাস্তা সরে যায়, সবুজ সরে গিয়ে দেখা দেয় লাল মাটি। কেউ একজন বলে, “আর একটা স্টেশন।”
আমার ছোটবেলার সেই প্রচন্ড সবুজের পাশ দিয়ে হাঁটছিলেন আমার বাবা এই সব গরম-পুজো-শীতের ছুটির অনেক বছর পর। সেখানে, ক্ষেত নয়, ফলের বাগান। তখন গ্রীষ্মকাল, তাই ফল নেই। ছায়া আছে। লোক আছে ইতস্তত। আর বাগানের মাঝখানে, মাথায় হাঁড়ি নয়, হেলমেট চাপিয়ে, দাঁড়িয়ে আছেন উর্দিপরা বন্দুকধারী যার আঙ্গুলের এক চাপে ভেঙে পড়বে সমস্ত কাল্পনিক সৌন্দর্য-বিলাস।
অন্য একটা লোক, অন্য কারুর বাবা, তার সন্তানের মুখে তুলে দিতে চাইবে হলুদ জলে সেদ্ধ হওয়া বরফের মত সাদা চালের ভাত, আর অনাহারে, অনিদ্রায় কেটে যাওয়া অনেক রাত্রির পর সেই সন্তানকে ঘুম পাড়াবে শুনিয়ে আজাদির গান, আর ভাববে, ওরা হয়তো কার্ফিউ তুলে নেবে। হয়তো আজ। হয়তো তুলে নেবে।
আমার বাবা জানবেন না, তাঁর হেঁটে যাওয়া ওই রাস্তা নিয়ে ইনশাহ্ মালিক লিখবেন কাশ্মিরি মেয়েদের কথা। লিখবেন, ওই রাস্তা আশঙ্কায় ভরা, যেখানে আর্মি জিপ ঘোরে, আর কোনো এক মোটর সাইকেল আরোহি’র চুল বাতাসে ওড়ে বন্দুকের নলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়, তার বুকে গোল গর্ত খোদাই করা আছে।
আমার বাবা জানেন না তখন, তাঁর এই হেঁটে যাওয়ার কয়েক গ্রীষ্ম পর আরেক রকম এক গ্রীষ্মকাল নিয়ে লিখবেন নুস্রত বাজা, যে গ্রীষ্মে আবার নাম না করা একদল মানুষ এসে তার স্বপ্নগুলোকে পিষে দেয় বুটের তলায়, তার শরীরে ফুটিয়ে তোলে পেলেটের দাগ, নিজেদের তীক্ষ্ণ বাক্যবাণে ডুবিয়ে দেয় তার গলার আওয়াজ…কিন্তু, আবার, এই গ্রীষ্মতেও, ব্যর্থ হয় তারা।
যেভাবে ব্যর্থ হয়ে যায় কান্হাইলালের দোপ্দি, মহাশ্বেতা দেবীর দ্রৌপদি’র নগ্নতার সামনে একালের অর্জুনের যৌন আস্ফালন। তার কয়েক বছর পর সত্যিই মণিপুর থেকে এমন একটা ছবি দেখে সারা পৃথিবী কেঁপে উঠেছিল, উঠে না থাকলে, কেঁপে ওঠা উচিৎ ছিল, যেভাবে আমরা, প্রেক্ষাগৃহের ভেতর, নিরাপদ হয়েও, কেঁপে উঠছিলাম সাবিত্রী দেবীকে দেখে।
বন্দী শিবির থেকে
ইন্টারনেট নেই।
তবুও আমাদের আকাশ আজাদ
আমাদের শেখাচ্ছে সাবলীল কথা-বলা
নিস্তব্ধতার ভাষায়।
প্রিয় অক্যুপায়ার,
তুমি এখনো শুনতে পাচ্ছ না
আমাদের নিস্তব্ধতা থেকে জেগে উঠছে
কী ভীষণ গর্জনে স্লোগান?
নিস্তব্ধতার রঙ লাল।
এক খাদ্যরসিক ইতালিয়ান পুলিশ ইন্সপেক্টর
সমুদ্রের ধারে ইতালির এই ছোট্ট শহর। এখানে, এক বাক্যে অনেকেই স্বীকার করবেন, কালোজেরো’র রেস্তোরা’র খাবারটাই সেরা। আমাদের পুলিশ ইস্পেক্টর মন্তালবানো’র কথাই ধরা যাক। প্রায় প্রত্যেক দুপুরেই তাকে এখানে দেখা যাবে। যদিও বয়স বাড়ছে, রসনা তা মানতে নারাজ। তাই এক প্লেটের অঙ্গীকার থেকে ক্রমশ দু’প্লেট, তিন প্লেট…বাড়তেই থাকে। বিবেকের দংশন এবং উদরের ভার – দুই-ই লাঘব করার জন্য তাই মন্তালবানো খাওয়া সেরে হাঁটতে বেরোয় মাঝে মাঝে। কাছেই বন্দর। মন্তালবানো তার প্রিয় পাথরের ওপর বসে একটা সিগারেট ধরায়। বন্দরের একটা গন্ধ আছে নাকি। সামুদ্রিক আগাছা, মাছ, জল – সব মিলিয়ে একটা আঁশটে, বদ্খত গন্ধ। কিন্তু মন্তালবানোর ভালো লাগে। ভালো লাগে পাথরের ওপর বসে এই সিগারেটে সুখটান, নিজের সঙ্গে এই দশ মিনিট।
কিন্তু মাঝদুপুরের এই শান্তির ছবিই পাল্টে যায় একেক রাত্রিবেলা। সীমান্তের ওপার থেকে, আফ্রিকা থেকে, ভেসে আসে ডিঙি নৌকো, তাতে গাদাগাদি মানুষ। তখন সেখানে থাকলে আরেকটা গন্ধ পায় মন্তালবানো। নৌকোয় কোনোমতে বসে থাকা এই মানুষদের গন্ধ। তাদের গায়ের গন্ধ নয়। অনেকদিন না কাচা জামা-কাপড়ের গন্ধ নয়। আশঙ্কা, ভয়, দুশ্চিন্তা, যন্ত্রণা, আকুলতা মেশানো সে এক অদ্ভুত গন্ধ যা দুনিয়ার সব ঘর-ছাড়াদের শরীরে লেগে থাকে। মন্তালবানো’র মুখ ঘুরিয়ে নিতে ইচ্ছে করে।
ঘর একটা হাঙরের মুখ
কেউ বেছে নেয় না উদ্বাস্তু শিবির
নগ্ন শরীরে সন্দেহের স্পর্শ- সৃষ্ট ব্যথা
অথবা কয়েদখানা
কারণ কয়েদখানা
অগ্নিগর্ভ শহরের চেয়ে বেশি নিরাপদ
আর রাত্রিবেলা একজন জেলরক্ষী বরং ভালো
ট্রাকভর্তি পিতৃসম পুরুষের চেয়ে।
কেউ পারত না
কেউই সহ্য করতে পারত না
কোনো চামড়া এত পুরু নয়…
দেওয়াল লিখন
‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখে অভীকের মা নাকি বলেছিলেন, এই গল্প তাঁর চেনা, নীতার সংসার তাঁর চেনা। নীতা, আমরা জানি, মুখে রক্ত তুলে মরে যাবে। নীতা জানার আগে আমরা জানি তার প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে যাবে, পর্দার আড়াল থেকে মুহূর্তের জন্য দেখা যাবে হাত, ভেসে আসবে চুড়ির আওয়াজ…নীতা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসবে আর… কোনো টুংটাং নয়, আছড়ে পড়বে চাবুকের আওয়াজ।
ইরানের দেওয়ালে দেওয়ালে রেখা ফুটে উঠবে, ফুটে উঠবে ছবি, হরফ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাই দেওয়ালে দেওয়ালে প্রতিবাদ, ফুটে উঠবে। দেওয়াল আসলে আয়নার মত। একটা বাড়ির আয়না, শহরের আয়না, এই দুনিয়াটার আয়না। মেঘ যেমন আকাশে, তেমনি সব ছাঁদের, সব আকারের প্রতিবিম্ব দেওয়ালে বয়ে যায়। যা কিছু গোপনে ছিল, তাকে আমরা দেখতে শিখি আয়নার মধ্যে দিয়ে। দেওয়ালের স্বাধীনতা ভেঙে ফেলে জেলের দেওয়াল। বাস্তব উন্মোচিত হয় যখন, স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ওঠে…দেওয়ালও একদিন আমাদের আকাঙ্ক্ষার মত স্বচ্ছ হয়ে যাবে।
প্রভুর মেহেরবানি, তাই হয়তো কারিমি’র গর্দ্দান বেঁচে যাবে। ছ’বছর জেল হবে, শরীরে ফুটে উঠবে দুশো তেইশটা চাবুকের রেখা, তাতে কি? থানার মোড়ে বাস ঘুরবে, আমি তাকিয়ে দেখব দুশো তেইশ। আমি ভাবব, কেইয়ান কারিমি।
আমরা আমাদের গান গাই, ওরা চায় না…
দিল্লির দেয়ালে, মিঞা, ঠাঁই নেই ঊর্দু হরফের
তোমার জবানে, মিঞা, গেরুয়া শিকল।
ধর্মের সওয়ারি কত দিল্লির প্রাণভোমরা
লুটে নিয়ে গেল, তবু,
দস্যুর তক্মা, মিঞা, তোমারই পূর্বপুরুষের।
ঊর্দু কবিতায়, মিঞা, ছায়া ফেলে বিদেল,
গালিব; ইতিহাস ঢেকে দেয় বিরল আতরে।
নিষিদ্ধ করবে ভাষা রঙ লেপে দেয়ালে দেয়ালে?
বাগিচা, বাতাস, মিঞা, ঊর্দু শ্বাস নেয়।
দিল্লির গভীরে কবরও ঊর্দুভাষী
এমনকি টিয়াপাখি, সাঁঝবেলা, আমার হৃদয়।
বসন্ত আসবেই
এক বাচ্চা মেয়েকে আমি চিনেছিলাম একদিনের জন্য যে নিজেকে ভুতু বলে ডাকত। ভুতু তখন বেশ ছোট। ওকে মাঝেমধ্যে ওর দাদু-দিদা’র ছোটবেলার গল্প শোনানো হত। মন দিয়ে গল্প শুনে সেই মেয়ে প্রশ্ন করত, “আর ভুতু তখন কোথায় ছিল?” বড়রা বোঝাত ওকে, “তোমার তখন জন্ম হয়নি।” বলত, “তুমি তো ছিলে না তখন।” ভুতু কিন্তু প্রত্যেকবার বলত, “না, ভুতু ছিল তো। ওই যে দাদু যখন কাদায় পা পিছলে পড়ে গেল, ভুতু পাশেই ছিল।” বা, “দিদা যখন নাচের স্কুলে যাচ্ছিল, ভুতুও হাঁটছিল পিছন পিছন।” তার জন্মের আগে তার পরিচিত যারা যে রাস্তা দিয়ে হেঁটেছে, যে বাড়িতে থেকেছে, যেখানে বেড়াতে গেছে, মেয়েটির দাবি ছিল, সেও সেখানে ছিল, কেউ তাকে দেখতে পায়নি। সদ্য কথা বলতে শেখা একরত্তি একটা মেয়ে, সে ভাবতে পারেনি এমন কোনো স্মৃতি আছে যার সে অংশ নয়, যাদের সে জন্ম থেকে চেনে তাদের জীবনে এমন কোনো সময় কেটেছে যখন সে নেই। নিজেকে ভুতু বলে ডাকা সেই মেয়েটা জানত না তখন, জানার কথাও নয়, এই স্মৃতি তার উত্তরাধিকার। ওই মাঠের পাশে, ওই নাচের স্কুলের রাস্তায় কোনোদিন না হেঁটেও, ওই মাঠ ওই রাস্তা’র স্মৃতি আসলে যতটা এই বুড়ো-বুড়ির, ততটাই ওর হবে, হতে থাকবে। যেভাবে, আমিও হেঁটে ফেলেছি, কোনোদিন বাংলাদেশ না গিয়েও, বাংলাদেশের প্রতি কোনো নাড়ির টান কোনোদিন অনুভব না করেও, হেঁটে ফেলেছি বরিশাল আর ফরিদপুরের রাস্তায় রাস্তায়; যেভাবে, ছয়ের দশক তার জ্বলে ওঠা আর নিভে যাওয়া নিয়ে আমার মধ্যে ঘোরাফেরা করে, সেই ভাবে। সেইভাবেই আমার মায়ের ছোটবেলার মফস্বল একেকদিন কলকাতার ভীড় ঠেলে আমার মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঢুকে পড়ে ঝাড়গ্রাম, কৃষ্ণনগর। ঢুকে পড়ে কলকাতায় একাত্তর সাল, ঢুকে পড়ে আলিপুর জেলের সামনে আমার মায়ের দেখা সদ্য মুক্তি পাওয়া কানু সান্যালের মুখ, ঢুকে পড়ে ইমার্জেন্সি। এমনকি, ঢুকে পড়ে ভেঙে যাওয়া বার্লিনের দেওয়াল।
আর আমরা? আমরা কী তৈরি করেছি? কোন স্মৃতি? ভয়ানক নেশার ঝোঁকে সমুদ্রের ধারে ভেঙে যাওয়া গাড়ি, মোবাইল টাওয়ার, উন্নত থেকে আরো উন্নতমানের যন্ত্র ও তার ব্যবহার – এই সব? যে যুবতী, নিছকই অভ্যেসের বশে, আজ থেকে শতবর্ষ পরে পেছনে তাকাবে, যন্ত্রের ধ্বংস্তুপ ছাড়া কিছুই কী চোখে পড়বে না তার? চোখে পড়বে না, অন্তত, পৃথিবীর তিন প্রান্তের এক ছবি – যন্ত্র নয়, মানুষের ঢল? চোখে পড়বে না তাহ্রির? ট্যাক্সিম? প্রজন্ম চত্বর?
কৃতজ্ঞতা স্বীকার:
http://indiegames.com/2016/05/a_heartbreaking_game_-_liyla_a.html
http://www.warscapes.com/poetry/refugees-some-poems
Newly Translated: Poems to Read for Ashraf Fayadh on January 14
http://www.puntodevistafestival.com/en/noticias.asp?IdNoticia=399
মানস ফিরাক ভট্টাচার্য
K.M